ভারতকে ছাড়া বাংলাদেশ কি আত্মনির্ভর হতে পারে? এটা কিভাবে সম্ভব?

Spread the love

বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, তবে ভারতের সাথে বাণিজ্য বা সহযোগিতার উপর নির্ভর না করে সম্পূর্ণ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন একটি জটিল চ্যালেঞ্জ উপস্থাপন করে। তবে, বাংলাদেশের পক্ষে তার অর্থনৈতিক ও কৌশলগত অংশীদারিত্বকে বৈচিত্র্যময় করে, দেশীয় শিল্পকে শক্তিশালী করে এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়িয়ে ভারতের উপর নির্ভরতা হ্রাস করা সম্ভব। উদাহরণ এবং রেফারেন্স সহ বাংলাদেশ কীভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে কাজ করতে পারে তা এখানে দেওয়া হলঃ

বাণিজ্য অংশীদারদের বৈচিত্র্য
বাণিজ্য সম্পর্ক সম্প্রসারণঃ বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের সাথে, বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পূর্ব এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক সম্প্রসারণের মাধ্যমে ভারতের উপর নির্ভরতা হ্রাস করতে পারে। এর সঙ্গে রপ্তানির জন্য নতুন বাজার খোঁজা এবং আমদানির বিকল্প উৎস সুরক্ষিত করা জড়িত থাকবে।
উদাহরণস্বরূপঃ বাংলাদেশ চীনের সাথে তার বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করেছে, যা তার অন্যতম বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার হয়ে উঠেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানের সঙ্গেও দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে।

প্রসঙ্গঃ বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশের বাণিজ্য বৈচিত্র্য প্রচেষ্টার বিশ্লেষণ চীন এবং অন্যান্য অপ্রচলিত অংশীদারদের সাথে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যের পরিমাণকে তুলে ধরেছে।

দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি
কৃষি ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতাঃ খাদ্য উৎপাদনে আরও বেশি স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে বাংলাদেশ কৃষি উৎপাদনশীলতার উন্নতির দিকে মনোনিবেশ করতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে কৃষির আধুনিকীকরণ, সেচ ব্যবস্থার উন্নতি এবং উচ্চ ফলনশীল ফসলের ব্যবহারকে উৎসাহিত করা।

উদাহরণস্বরূপঃ বন্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত এবং উন্নত চাষাবাদ কৌশলের প্রবর্তন ইতিমধ্যে বাংলাদেশকে ধান উৎপাদনে অনেকাংশে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলেছে।

আন্তর্জাতিক খাদ্য নীতি গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইএফপিআরআই) বাংলাদেশের কৃষি সংস্কারের উপর কেস স্টাডি প্রদান করে যা খাদ্য উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে।

শক্তির স্বাধীনতাঃ সৌর, বায়ু এবং জলবিদ্যুৎ শক্তির মতো পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির উৎসের বিকাশ বাংলাদেশকে আমদানিকৃত শক্তির উপর নির্ভরতা হ্রাস করতে সহায়তা করতে পারে। দেশ ইতিমধ্যেই গ্রামাঞ্চলে সৌরশক্তির ব্যবহার সম্প্রসারণে অগ্রগতি অর্জন করেছে।

উদাহরণস্বরূপঃ বিশ্বব্যাংক এবং ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (আইডিসিওএল)-এর সহায়তায় বাংলাদেশে সোলার হোম সিস্টেম (এসএইচএস) উদ্যোগ বাংলাদেশকে অফ-গ্রিড সৌরশক্তির ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী অগ্রণী করে তুলেছে, লক্ষ লক্ষ গ্রামীণ পরিবার এখন সৌরশক্তি ব্যবহার করছে।

তথ্যসূত্রঃ বাংলাদেশের পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানি খাতে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে সৌরশক্তির প্রবেশাধিকার সম্প্রসারণে দেশের অগ্রগতি তুলে ধরা হয়েছে।

 

আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করা
দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতাঃ বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক সম্পর্ককে বৈচিত্র্যময় করতে এবং ভারতের উপর নির্ভরতা কমাতে অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় দেশগুলির পাশাপাশি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকার সাথে সহযোগিতা বাড়াতে পারে। বিমসটেকের (বে অফ বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন) মতো সংস্থাগুলি বাণিজ্য, জ্বালানি ও পরিকাঠামো ক্ষেত্রে আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্য মঞ্চ প্রদান করে।

উদাহরণস্বরূপঃ বাংলাদেশ বিমসটেকে সক্রিয় রয়েছে, যার মধ্যে থাইল্যান্ড, মায়ানমার এবং শ্রীলঙ্কার মতো সদস্য রয়েছে। এই সংস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশ ভারতের উপর নির্ভরশীলতার বাইরেও আঞ্চলিক প্রকল্প এবং বাণিজ্যের সুযোগগুলি কাজে লাগাতে পারে।
বিমসটেকের আনুষ্ঠানিক প্রকাশনাগুলি সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সহযোগিতার জন্য চলমান প্রকল্প এবং সুযোগগুলির বিশদ বিবরণ দেয়।
দেশীয় শিল্পের উন্নয়ন
শিল্পায়ন ও রপ্তানি বৈচিত্র্যঃ বাংলাদেশ তার প্রভাবশালী বস্ত্র ও পোশাক শিল্পের বাইরেও উৎপাদন খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে শিল্পায়নকে উৎসাহিত করতে পারে। ফার্মাসিউটিক্যালস, জাহাজ নির্মাণ এবং ইলেকট্রনিক্সের মতো উন্নয়নশীল ক্ষেত্রগুলি নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করতে পারে।

উদাহরণস্বরূপঃ বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, দেশটি এখন 150টিরও বেশি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে। এই সাফল্য অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং আমদানির উপর নির্ভরতা হ্রাস করার সম্ভাবনা দেখায়।

তথ্যসূত্রঃ বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ (বিএপিআই) ফার্মাসিউটিক্যাল সেক্টরের বৃদ্ধি ও রপ্তানি সম্ভাবনার তথ্য সরবরাহ করে।

বস্ত্র শিল্পের বৈচিত্র্যঃ যদিও বস্ত্র শিল্প ভারত থেকে কাঁচামালের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, বাংলাদেশ অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করে বা নিজস্ব উৎপাদন ক্ষমতা বিকাশের মাধ্যমে তার উৎসগুলিকে বৈচিত্র্যময় করতে পারে।

উদাহরণস্বরূপঃ বাংলাদেশ তার বস্ত্র শিল্পের জন্য ভারতীয় আমদানির উপর নির্ভরতা হ্রাস করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, উজবেকিস্তান এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ থেকে তুলা আমদানি করে আসছে।

তথ্যসূত্রঃ বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) তুলা আমদানি এবং উৎসের বৈচিত্র্য সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করে।

পরিকাঠামো উন্নয়ন
পরিবহন ও লজিস্টিকঃ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পরিবহন ও লজিস্টিক পরিকাঠামোর উন্নতি হলে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সহজতর হতে পারে। দক্ষ বাণিজ্য পথগুলিকে সমর্থন করার জন্য বন্দর, বিমানবন্দর এবং সড়ক নেটওয়ার্কগুলিকে আধুনিকীকরণ করা উচিত

 

উদাহরণস্বরূপঃ দক্ষিণ বাংলাদেশে পায়রা সমুদ্র বন্দরের উন্নয়নের উদ্দেশ্য হল নতুন বাণিজ্য পথ তৈরি করা, ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য ভারতীয় বন্দরগুলির উপর নির্ভরতা হ্রাস করা।
তথ্যসূত্রঃ বাংলাদেশের নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় পায়রা বন্দরের উন্নয়নসহ চলমান পরিকাঠামো প্রকল্পের বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করে।

প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এবং এফডিআই আকৃষ্ট করার জন্য প্রযুক্তি হস্তান্তরঃ একটি অনুকূল বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করে, বাংলাদেশ স্বনির্ভরতা বৃদ্ধির জন্য মূলধন, প্রযুক্তি এবং দক্ষতা নিয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারে।

উদাহরণস্বরূপঃ দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান এবং U.S. সংস্থাগুলির বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তি ও টেলিযোগাযোগ খাতে FDI আকৃষ্ট করতে সফল হয়েছে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) বাংলাদেশে এফডিআই প্রবণতা এবং সুযোগ সম্পর্কে প্রতিবেদন সরবরাহ করে।

রেমিট্যান্সের কৌশলগত ব্যবহার
উন্নয়নের জন্য রেমিট্যান্সের ব্যবহারঃ প্রবাসী বাংলাদেশীদের কাছ থেকে পাঠানো রেমিট্যান্স অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই তহবিলগুলিকে পরিকাঠামো, শিক্ষা এবং প্রযুক্তির মতো উৎপাদনশীল ক্ষেত্রে যথাযথভাবে ব্যবহার করা আত্মনির্ভরতার প্রচেষ্টাকে সমর্থন করতে পারে।
উদাহরণস্বরূপঃ মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকদের উল্লেখযোগ্য অবদান সহ দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম রেমিট্যান্স প্রবাহ রয়েছে।

তথ্যসূত্রঃ বিশ্বব্যাংকের “মাইগ্রেশন অ্যান্ড রেমিটেন্স ফ্যাক্টবুক” বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিটেন্সের প্রভাব সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করে।

উপসংহার
যদিও ভারতের উপর কোনও নির্ভরতা ছাড়াই সম্পূর্ণ স্বনির্ভরতা অর্জন করা বাংলাদেশের পক্ষে চ্যালেঞ্জিং হতে পারে, তবে বাণিজ্যের বৈচিত্র্য, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি, আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার এবং কৌশলগত শিল্প বিকাশের মাধ্যমে নির্ভরতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা অবশ্যই সম্ভব। এই ক্ষেত্রগুলিতে মনোনিবেশ করে বাংলাদেশ আরও স্থিতিস্থাপক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারে। তবে, বিশ্ব বাণিজ্যের আন্তঃসংযুক্ত প্রকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে, সম্পূর্ণ স্বয়ংসম্পূর্ণতা কঠিন এবং ভারত সহ প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে কৌশলগত সহযোগিতা সম্ভবত গুরুত্বপূর্ণ থাকবে।

মনিরুল ইসলাম শামীম, আইনজীবী
আইন গবেষক, নীতি বিশ্লেষক,
লন্ডন।

CEO of ‘Bangladeh Policy Research Institute’

Bpr.institute24@gmail.com
03.09.2024

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *