কেউ জানত না যে ১৯৪৭ সালের ৩ জুন ভারতের স্বাধীনতার তারিখ ঠিক করা হবে।
ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন ১৯৪৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এবং ভারত বিভাজনের ঘোষণা করবেন, কিন্তু সেটা কোন তারিখে হবে তা অনিশ্চিত ছিল।
ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন সেদিন ‘৩ জুন প্ল্যান’ অর্থাৎ ‘মাউন্টব্যাটেন প্ল্যান’ ঘোষণা করবেন।
এই ঘোষণার ঠিক এক রাত আগে, তিনি কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতাদের সাথে দু’টি বৈঠক করেন। ডমিনিক ল্যাপিয়ের ও ল্যারি কলিন্সের ‘ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট’ বই থেকে এমনটা জানা যায়।
সেখানে বলা হয়, ওই রাতে ভাইসরয় ভবনের টানা বারান্দায় অন্ধকার ও নীরবতার পসরা বসেছিল।
ল্যাপিয়ের ও কলিন্স লিখেছেন যে ১৯৪৭ সালের ২ জুন, সাতজন ভারতীয় নেতা চুক্তির কাগজপত্র পড়তে এবং শুনতে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের কক্ষে দেখা করতে যান।
কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে ছিলেন জওহরলাল নেহেরু, সর্দার প্যাটেল ও আচার্য কৃপালানি।
মুসলিম লীগ থেকে ছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান ও আবদুররাব নিশতার। অন্যদিকে, বলদেব সিং সেখানে পৌঁছেছিলেন শিখদের প্রতিনিধি হিসেবে।
এটিই ছিল প্রথম কোনো বৈঠক যেখানে মহাত্মা গান্ধী উপস্থিত ছিলেন না।
মাউন্টব্যাটেন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে এই বৈঠকে কোনো আলোচনা হবে না। এ কারণে তিনি জিন্নাহকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ক্যাবিনেট মিশনে যে পরিকল্পনা করা হয়েছে তিনি কী সেভাবেই ভারতকে গ্রহণ করবেন? জিন্নাহ এজন্য প্রস্তুত ছিলেন না।
এরপর লর্ড মাউন্টব্যাটেন একে একে তার পরিকল্পনার রূপরেখা দেন :
১. পাঞ্জাব ও বাংলার হিন্দু ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলার কাউন্সিলরদের আলাদা বৈঠকে ডাকা হবে।
২. কোনো দল প্রদেশ ভাগ করতে চাইলে তা করা হবে।
৩. দু’টি ডোমিনিয়ন এবং দু’টি গণপরিষদ গঠন করা হবে।
৪. সিন্ধু প্রদেশ নিজের সিদ্ধান্ত নেবে।
৫. তারা ভারতের কোন অংশের সাথে থাকতে চায় তা নির্ধারণ করতে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এবং আসামের সিলেটে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে।
৬. ভারতীয় রাজ্যগুলোকে স্বাধীন থাকার ক্ষমতা দেয়া যাবে না। তাদের ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দিতে হবে।
৭. হায়দ্রাবাদ পাকিস্তানে যোগ দেবে না।
৮. বিভাজনে কোনো অসুবিধা হলে সীমানা নির্ধারণ কমিশন গঠন করা হবে।
বক্তব্য শেষ করে মাউন্টব্যাটেন বলেন, ‘আমি চাই আপনারা সবাই মধ্যরাতের মধ্যে এই পরিকল্পনার উত্তর দিন।’
তিনি আশা করেছিলেন যে মধ্যরাতের আগে মুসলিম লীগ, কংগ্রেস ও শিখরা এই পরিকল্পনা মেনে নিতে সম্মত হবে।
দ্বিতীয় বৈঠক, গান্ধীর নীরবতা
মহাত্মা গান্ধী প্রথম বৈঠকে যোগ দিতে অস্বীকার করেন, কারণ তিনি কংগ্রেসের কোনো পদে ছিলেন না। কিন্তু তার উপস্থিতি পুরো সভাকে ছাপিয়ে যায়। লর্ড মাউন্টব্যাটেন গান্ধীকে অনেক সম্মান করতেন।
এরপর মধ্যরাতে আরেকটি সভা হয় এবং গান্ধী এতে যোগ দেন। মাউন্টব্যাটেন ভয় পেয়েছিলেন যে গান্ধী এমন কিছু বলবেন যা উভয়ের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করতে পারে।
ল্যাপিয়ের ও কলিন্স লিখেছেন যে মাউন্টব্যাটেন তার চেয়ার থেকে উঠে মহাত্মা গান্ধীকে স্বাগত জানাতে দ্রুত এগিয়ে গেলেন কিন্তু হঠাৎ তিনি মাঝপথে থামলেন।
গান্ধী তার ঠোঁটে আঙুল রেখে তাকে থামালেন। ভাইসরয় বুঝতে পেরেছিলেন যে আজ গান্ধীর নীরবতা পালনের দিন।
এরপর মাউন্টব্যাটেন তার পুরো পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করেন। গান্ধী একটি খাম নিয়ে তার পিছনে কিছু লিখতে লাগলেন।
লিখতে লিখতে তিনি পাঁচটি খাম ভরে ফেলেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য লর্ড মাউন্টব্যাটেন সেই খামগুলো সংরক্ষণ করেছিলেন।
গান্ধী লিখেছিলেন, ‘আমি দুঃখিত যে আমি কথা বলতে পারছি না। আমি প্রতি সোমবার নীরবতার ব্রত পালন করি।’
তিনি আরো লেখেন, ‘নীরবতার ব্রত নেয়ার সময়, আমি কেবল দু’টি পরিস্থিতিতে তা ভাঙার সুযোগ রেখেছি। প্রথমত, কোনো জরুরি সমস্যা দেখা দিলে এবং দ্বিতীয়ত, যখন আমার অসুস্থ কাউকে দেখাশোনা করতে হয়। আমি জানি যে তখন আমাকে দু’টি বিষয়ে কিছু বলতে হবে। কিন্তু আমি জানি আপনি চান না আমি আজ আমার নীরবতা ভাঙ্গি। আমার কিছু বলার আছে, কিন্তু আজ নয়। আবার দেখা হলে অবশ্যই বলব।’ এরপর গান্ধী সেখান থেকে উঠে চলে যান।
জিন্নাহর একগুঁয়েমি আর নিস্পৃহ মাউন্টব্যাটেন
লর্ড মাউন্টব্যাটেন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কংগ্রেস ও শিখদের কাছ থেকে সম্মতি পেয়ে যান, কিন্তু মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ রাজি ছিলেন না। ডমিনিক ল্যাপিয়ের ও ল্যারি কলিন্সের বইতে এই ব্যাখ্যা উঠে আসে।
তিনি লিখেছেন যে জিন্নাহ তখনও ‘হ্যাঁ’ বলতে অনিচ্ছুক ছিলেন, কিন্তু লর্ড মাউন্টব্যাটেনও তাকে ‘হ্যাঁ’ বলার জন্য তার মন তৈরি করেছিলেন।
প্রথমে দু’জনের মধ্যে শান্তিপূর্ণভাবে কথাবার্তা চলতে থাকে, জিন্নাহ বিষয়টি এড়িয়ে যান এবং অবশেষে মাউন্টব্যাটেন বলেন, ‘মিস্টার জিন্নাহ, আমি আপনাকে একটি কথা বলতে চাই যে আমি আপনাকে আমার পরিকল্পনা নষ্ট করতে দেব না। আগামীকাল বৈঠকে আমি যা বলার বলব। আমি কংগ্রেসের কাছ থেকে উত্তর পেয়েছি এবং আমি এটি পরিষ্কার করব।’
লর্ড মাউন্টব্যাটেন বলেন, ‘এরপর আমি বলব যে গত রাতে জিন্নাহ সাহেবের সাথে আমার একটি দীর্ঘ বন্ধুত্বপূর্ণ কথোপকথন হয়েছে, আমরা এই পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেছি এবং জিন্নাহ সাহেব আমাকে ব্যক্তিগতভাবে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে তিনি এই পরিকল্পনার সাথে একমত হবেন। ওই সময় আমি আপনার দিকে ফিরে তাকাব। আমি চাই না আপনি তখন কিছু বলেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমি আপনার কাছ থেকে একটাই জিনিস চাই আর তা হচ্ছে, আপনি আপনার মাথা নাড়বেন, যাতে মনে হয় যে আপনি আমার সাথে একমত হয়েছেন। আপনি যদি মাথা না নাড়েন, তবে বুঝবেন আমি আপনার জন্য কিছুই করতে পারব না। আপনার বানানো খেলা নষ্ট হয়ে যাবে। সবকিছু ভেঙ্গে পড়বে।’
বিভাজনের ঘোষণা
এরপর যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল ঠিক তেমনটাই ঘটে। ভারতবর্ষের বিভাজন এবং স্বাধীনতার বিষয়ে, লর্ড মাউন্টব্যাটেন আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের জন্য ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সাথে একটি বৈঠক করেন, যেখানে সবকিছু একইভাবে ঘটেছিল যেভাবে তিনি আগের রাতে জিন্নাহকে বলেছিলেন।
১৯৪৭ সালের ৩ জুন সন্ধ্যা ৭টার দিকে, সব শীর্ষ নেতা আনুষ্ঠানিকভাবে দু’টি পৃথক দেশ গঠনে তাদের সম্মতি ঘোষণা করেন।
লর্ড মাউন্টব্যাটেন প্রথম বক্তৃতা দেন। এরপর নেহেরু হিন্দিতে বলেন, ‘বেদনা ও যন্ত্রণার মধ্যে, ভারতের মহান ভবিষ্যত তৈরি হচ্ছে।’
এরপর জিন্নাহর পালা এলে তিনি ইংরেজিতে ভাষণ দেন এবং পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়ে তার বক্তব্য শেষ করেন।
তার ভাষণটি পরে একজন রেডিও ঘোষক উর্দুতে পড়ে শোনান। রেডিওতে দেশভাগের সম্মতি ঘোষণা করা হয়।
পরের দিন, লর্ড মাউন্টব্যাটেন খবর পান যে মহাত্মা গান্ধী কংগ্রেস নেতাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে একটি প্রার্থনা সভা করতে চলেছেন এবং আগের রাতের সভায় তিনি যা বলতে পারেননি, আজ তা বলবেন।
ল্যাপিয়ের ও কলিন্স তাদের বইতে লিখেছেন যে একটি প্রার্থনা সভা হয়েছিল, গান্ধী বলেছিলেন, ‘বিভাজনের জন্য ভাইসরয়কে দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই। নিজের দিকে তাকান, আপনার মস্তিষ্কে টোকা দিন, তাহলে বুঝবেন কী হয়েছে।’
স্বাধীনতার তারিখ কী হঠাৎ করেই ঠিক হলো?
পরের দিন লর্ড মাউন্টব্যাটেন একটি সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন এবং তার পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করেন যা ভারতবর্ষের মানচিত্র বদলে দিতে যাচ্ছিল। ভাইসরয়ের বক্তৃতা সবাই মনোযোগ দিয়ে শোনে আর প্রশ্ন করে।
তারপর একটি প্রশ্ন ওঠে যার কোনো উত্তর নিশ্চিত ছিল না। প্রশ্নটি ছিল, ‘যদি সবাই একমত হন যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ক্ষমতা হস্তান্তর করা উচিত, তো স্যার এক্ষেত্রে আপনি নিশ্চয়ই কোনো তারিখ ভেবেছেন?‘
‘ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট’ বইটিতে ডমিনিক ল্যাপিয়ের ও ল্যারি কলিন্স লেখেন, ‘মাউন্টব্যাটেন ভেতরে ভেতরে ছটফট করতে থাকেন কারণ তিনি কোনো তারিখ নির্ধারণ করেননি। তবে তিনি বিশ্বাস করতেন যে এই কাজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করা উচিত। সবাই ওই তারিখ শোনার অপেক্ষায় ছিল। হলঘরে বিরাজ করছিল নিস্তব্ধতা।’
ল্যাপিয়ের ও কলিন্স লিখেন, লর্ড মাউন্টব্যাটেন পরে এই ঘটনার কথা মনে করে বলেছিলেন, ‘আমি এটা প্রমাণ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম যে সবকিছুই আমার করা।’
হঠাৎ মাউন্টব্যাটেন ওই সময় সংবাদ সম্মেলনে বলে ওঠেন, ‘আমি ক্ষমতা হস্তান্তরের তারিখ ঠিক করেছি।’ এ কথা বলার পর তার মনে অনেক তারিখ ঘুরতে থাকে।
তখন তার জীবনের সবচেয়ে গৌরবময় বিজয়ের স্মৃতির কথা মনে আসে, যখন জাপানের সেনাবাহিনী তার নেতৃত্বে আত্মসমর্পণ করেছিল। সেই আত্মসমর্পণের দ্বিতীয় বার্ষিকী কাছাকাছি ছিল।
ল্যাপিয়ের ও কলিন্স লিখেন, ‘মাউন্টব্যাটেনের কণ্ঠস্বর হঠাৎ জেগে ওঠে এবং তিনি ঘোষণা করেন যে ১৯৪৭ সালে ১৫ অগাস্টে ভারতের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়া হবে।’
হঠাৎ নিজের ইচ্ছায় স্বাধীনতার তারিখ স্থির করে সেটা ঘোষণা করার কারণে লন্ডন থেকে ভারত পর্যন্ত বিস্ফোরণ ঘটে।
লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতে ব্রিটিশ ইতিহাসের পর্দা এভাবে নামিয়ে দেবেন তা কেউ ভাবতেও পারেনি।
শেষ পর্যন্ত ১৪ ও ১৫ আগস্টের মধ্যবর্তী রাতে ভারত ভাগ হয় এবং পাকিস্তান একটি নতুন দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়। এখন দু’টি দেশ স্বাধীন কিন্তু এক নয়।
সূত্র : বিবিসি