বাংলাদেশ কি তার অবস্থান এবং কৌশলগত দক্ষতার জন্য ভবিষ্যতের ভূ-রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিতে পারে? বাংলাদেশের সর্বোত্তম নিরাপত্তা নিশ্চিত করে স্বল্প সময়ের নোটিশে বাংলাদেশ কীভাবে তা করতে পারে? কিছু উদাহরণ এবং রেফারেন্স:-

Spread the love

বাংলাদেশ তার অবস্থান এবং উদীয়মান কৌশলগত অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্যই ভূ-রাজনীতিতে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ভারত মহাসাগরের সংযোগস্থলে এর অবস্থান বাণিজ্য, জ্বালানি পথ এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যাইহোক, অদূর ভবিষ্যতে নিজেকে দৃঢ় করতে হলে, বাংলাদেশকে অবশ্যই তার কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তা শক্তির সংমিশ্রণ ব্যবহার করতে হবে।

আঞ্চলিক সংযোগের জন্য অবস্থানের সদ্ব্যবহার:
বাংলাদেশের অবস্থান এটিকে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ভারত মহাসাগরের মধ্যে সংযোগের প্রবেশদ্বার করে তুলেছে। এটি তিনদিকে ভারতের সীমানা, চিনের কাছাকাছি এবং বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে। পরিকাঠামো, বিশেষ করে বন্দর ও ট্রানজিট সুবিধার উন্নতির মাধ্যমে বাংলাদেশ বাণিজ্য ও রসদ সরবরাহের জন্য একটি আঞ্চলিক কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।

উদাহরণস্বরূপঃ • মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরঃ জাপানের সহায়তায় বাংলাদেশ মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর গড়ে তুলছে, যা দেশকে বঙ্গোপসাগরে সামুদ্রিক বাণিজ্য ও রসদ সরবরাহের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় করে তুলতে পারে। এই প্রকল্পটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া উভয় ক্ষেত্রেই আঞ্চলিক সরবরাহ শৃঙ্খলে বাংলাদেশের অবস্থানকে বাড়িয়ে তুলতে পারে।
ফ্রি অ্যান্ড ওপেন ইন্দো-প্যাসিফিক (এফওআইপি) কৌশলের অংশ হিসাবে মাতারবাড়ি প্রকল্পে জাপানের সম্পৃক্ততা আঞ্চলিক সংযোগে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান গুরুত্বকে তুলে ধরে।

দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান শক্তিগুলির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা:
বাংলাদেশ কার্যকরভাবে প্রতিবেশী ভারত ও চীনের সঙ্গে তার সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রেখেছে। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি অবস্থানের কারণে উভয় দেশেরই বাংলাদেশে কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে। উভয় শক্তির সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক বজায় রেখে, বাংলাদেশ একটির উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হওয়া এড়াতে পেরেছে, যার ফলে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে আরও বেশি সুযোগ তৈরি হয়েছে।

উদাহরণঃ বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) বাংলাদেশ চীনের অবকাঠামো বিনিয়োগ থেকে উপকৃত হয়ে চীনের বিআরআই-এ যোগ দিয়েছে। একই সময়ে, এটি ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে, যাতে এটি কোনও একটি দিকে খুব বেশি ঝুঁকে না পড়ে।
বাংলাদেশ চীনের সাথে বেশ কয়েকটি বিআরআই-সম্পর্কিত প্রকল্প স্বাক্ষর করেছে, তবে এটি তার ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতির চিত্র তুলে ধরে নিরাপত্তা ও বাণিজ্যেও ভারতের সাথে সহযোগিতা করে।

বঙ্গোপসাগরে সামুদ্রিক নিরাপত্তা জোরদার করা:
আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে জাহাজ চলাচলের পথ নিয়ন্ত্রণের জন্য বঙ্গোপসাগরকে কৌশলগতভাবে ক্রমবর্ধমান গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসাবে দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশ, তার ক্রমবর্ধমান নৌ সক্ষমতার সাথে, জলদস্যুতা এবং অবৈধ মাছ ধরার মতো হুমকির বিরুদ্ধে এই জলসীমাকে সুরক্ষিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা জোটে অংশীদার হিসাবে কাজ করতে পারে।

উদাহরণঃ বাংলাদেশ নৌবাহিনীর আধুনিকীকরণঃ বাংলাদেশ তার নৌবাহিনীকে নতুন ফ্রিগেট, সাবমেরিন এবং উপকূলীয় নজরদারি ব্যবস্থা দিয়ে উন্নীত করছে। এই প্রচেষ্টাটি আঞ্চলিক সামুদ্রিক নিরাপত্তায় এর ভূমিকা বাড়ানোর জন্য তৈরি করা হয়েছে, যার ফলে এটি বঙ্গোপসাগরে বহুজাতিক মহড়া এবং টহলদারিতে অংশ নিতে পারে।
বাংলাদেশের “ফোর্সেস গোল 2030” প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা আঞ্চলিক নিরাপত্তা, বিশেষ করে তার সামুদ্রিক অঞ্চলগুলিতে নিশ্চিত করতে তার নৌ ও বিমান বাহিনীকে শক্তিশালী করার উপর জোর দেয়।

আঞ্চলিক প্রভাবের জন্য কূটনৈতিক মঞ্চের ব্যবহার:
বাংলাদেশ সার্ক, বিমসটেক এবং ভারত মহাসাগর রিম অ্যাসোসিয়েশনের মতো আঞ্চলিক সংস্থার সক্রিয় সদস্য। (IORA). এই ফোরামে নেতৃত্বের ভূমিকা গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ বাণিজ্য, নিরাপত্তা এবং দুর্যোগ মোকাবেলার মতো বিষয়ে আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ে তুলতে পারে।

উদাহরণঃ বিমসটেক নেতৃত্বঃ বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে সংযুক্তকারী বিমসটেকের অধীনে আরও শক্তিশালী আঞ্চলিক সহযোগিতার পক্ষে সওয়াল করে আসছে। আরও সুসংহত বাণিজ্য, পরিকাঠামো ও জ্বালানি প্রকল্পে জোর দিয়ে বাংলাদেশ আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় অগ্রণী হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশ 2018 সালে চতুর্থ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করে, আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রতি তার প্রতিশ্রুতি এবং এই গোষ্ঠীর এজেন্ডা গঠনের উচ্চাকাঙ্ক্ষার উপর জোর দেয়।

প্রভাবের জন্য অর্থনৈতিক কূটনীতি
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উত্থান, বিশেষ করে বস্ত্র ও উৎপাদনের মতো ক্ষেত্রে, আন্তর্জাতিক ফোরামে তার অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। অর্থনীতির বিকাশ অব্যাহত রেখে, শিল্পকে বৈচিত্র্যময় করে এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য সংযোগকে শক্তিশালী করে বাংলাদেশ তার নরম শক্তি ও প্রভাব বাড়াতে পারে।

উদাহরণঃ
টেক্সটাইল শিল্পঃ বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। এই ক্ষেত্রে তার অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে, এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আলোচনা এবং অর্থনৈতিক ফোরামে তার প্রভাব প্রসারিত করতে অর্থনৈতিক কূটনীতি ব্যবহার করতে পারে।
বিশ্ব বাণিজ্যে বাংলাদেশের গুরুত্ব ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দৃঢ় বাণিজ্য সম্পর্ক এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের দ্বারা আন্ডারস্কোর করা হয়।

 

কূটনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে রোহিঙ্গা সংকট
চলমান রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট, যেখানে বাংলাদেশ মায়ানমার থেকে এক মিলিয়নেরও বেশি শরণার্থীকে গ্রহণ করেছে, এটি নৈতিক কর্তৃত্ব এবং মানবিক কূটনীতিতে একটি বিশিষ্ট ভূমিকা দেয়। সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশ তার আন্তর্জাতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করতে পারে এবং আঞ্চলিক রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে।

উদাহরণঃ • রোহিঙ্গা ইস্যুতে কূটনৈতিক নেতৃত্বঃ রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের জন্য মায়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে বাংলাদেশ জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতসহ আন্তর্জাতিক ফোরামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ মানবাধিকার ও শরণার্থী কূটনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
রেফারেন্সঃ • রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের নেতৃত্ব আন্তর্জাতিক ফোরামে স্বীকৃতি অর্জন করেছে এবং এই ইস্যুতে অব্যাহত কূটনীতি এর বৈশ্বিক অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে।

ভূ-রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সমর্থন করতে জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা
ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশকে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হলে তার অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে সামরিক সক্ষমতা জোরদার করা, সীমান্ত সুরক্ষিত করা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। দেশের প্রতিরক্ষা আধুনিকীকরণ কর্মসূচি, বিশেষ করে নৌ ও বিমান বাহিনীতে, আঞ্চলিক নিরাপত্তা প্রদানকারী হিসাবে কাজ করার ক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

উদাহরণঃ
বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদী প্রতিরক্ষা আধুনিকীকরণ পরিকল্পনা, ফোর্সেস গোল 2030-এর লক্ষ্য হল সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনী-এই তিনটি শাখায় সামরিক সক্ষমতা বাড়ানো। এই উদ্যোগটি আঞ্চলিক নিরাপত্তা প্রচেষ্টায় অবদান রাখার পাশাপাশি বাংলাদেশ যাতে তার সামুদ্রিক সীমানা, আকাশসীমা এবং স্থল অঞ্চল রক্ষা করতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্য তৈরি করা হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা আধুনিকীকরণ, বিশেষত নৌ ও বিমান সক্ষমতার ক্ষেত্রে, এটি বঙ্গোপসাগরে এবং এর বাইরেও তার স্বার্থ সুরক্ষিত করার জন্য অবস্থান করে।

উপসংহার
বাংলাদেশ যখন রোহিঙ্গা সংকট, ভারত ও চীনের মধ্যে সম্পর্কের ভারসাম্য এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গতিশীলতার মতো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে, তখন আঞ্চলিক এবং এমনকি বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতিতে আরও প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করার সম্ভাবনা রয়েছে। কৌশলগত অবস্থান, কূটনৈতিক ভারসাম্য এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনীতিকে কাজে লাগিয়ে এবং শক্তিশালী জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করে বাংলাদেশ তার নেতৃত্বের ভূমিকা জোরদার করতে পারে। এই সুযোগগুলিকে বাস্তবে পরিণত করতে সঠিক নেতৃত্ব, বিশেষ করে দক্ষ পররাষ্ট্র সচিব এবং নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে, অপরিহার্য হবে।

তথ্যসূত্রঃ

1. মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরঃ মাতারবাড়ি প্রকল্পে বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতার বিষয়ে জাপান টাইমস।
2. বাহিনী লক্ষ্য 2030: প্রতিরক্ষা আধুনিকীকরণের জন্য বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের রোডম্যাপ।
3. বিমসটেক এবং বাংলাদেশের ভূমিকাঃ বিমসটেক সচিবালয় এবং দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক গবেষণা থেকে প্রতিবেদন।
4. রোহিংয়া সংকট কূটনীতিঃ জাতিসংঘের প্রতিবেদন এবং রোহিংয়া ইস্যুতে আই. সি. জে-এর কার্যক্রম।
এই উদাহরণগুলি দেখায় যে বাংলাদেশ কীভাবে অদূর ভবিষ্যতে আরও বিশিষ্ট ভূ-রাজনৈতিক খেলোয়াড় হওয়ার পথে এগিয়ে যেতে পারে।

মনিরুল ইসলাম শামিম, আইনজীবী,

আইন গবেষক, নীতি বিশ্লেষক,

সিইও, বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট,

Bpr.institute24 @gmail.com

London, 10.09.2024

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *