স্বৈরাচার শেখ হাসিনার প্ররোচনায় রাতারাতি আটটি ব্যাংকের মালিকানা পেয়েছিলেন এস আলম মাসুদ ওরফে এস আলম। এসব ব্যাংক থেকে অর্থ বের করার অন্যতম দুই সহযোগী ছিল আকিজ উদ্দিন ও মিফতা উদ্দিন। দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে অর্থ লুটপাটের হোতা এই এস আলম এবং তার দুই সহযোগী আকিজ উদ্দিন ও মিফতা উদ্দিনের বিরুদ্ধে ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ওপর ভাড়াটিয়া বাহিনীর দ্বারা হামলার অভিযোগ উঠেছে। ভাড়াটিয়া বাহিনীর হামলায় গতকাল ইসলামী ব্যাংকের সাত কর্মকর্তা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সদস্যসচিব রবিউল ইসলাম নয়নের নেতৃত্বে এ হামলা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে যুবদলের সভাপতি আব্দুল মোনায়েম মোল্লা গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, নয়নসহ যারাই এ ঘটনার সাথে জড়িত রয়েছেন তাদের বিরুদ্ধেই সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে ভাড়াটিয়া হিসেবে একটি টিভি চ্যানেলেও হামলার অভিযোগ উঠেছে এই নয়নের বিরুদ্ধে। এ কারণে আজ সোমবার বা আগামীকালের মধ্যেই নয়নকে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে বলে ওই সূত্র নিশ্চিত করেছে।
গতকাল এস আলমের দুর্বৃত্তদের হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, ইসলামী ব্যাংক কর্মকর্তা শফিউল্লাহ, আবদুল্লাহ আল মামুন, আব্দুর রহমান, বাকিবিল্লাহ। বাকি তিনজনের পরিচয় জানা যায়নি। তারা বর্তমানে ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের ফলে ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৬ আগস্ট এস আলম গ্রুপের নিয়োগকৃত কর্মকর্তাদের ব্যাংক থেকে বের করে দেন বিক্ষুব্ধ ব্যাংকাররা। এরপর গত ৭ ও ৮ আগস্ট ব্যাংকারদের বিক্ষোভ করতে দেখা যায়। এ সময় এস আলমের নিয়োগকৃত কর্মকর্তাদের ব্যাংক থেকে বের করে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। হামলার ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামী ব্যাংকের এসএভিপি ড. শওকত আলী বলেন, ‘গতকাল জানতে পারি, এস আলমের বিভিন্ন কোম্পানি ও ব্যাংকের যারা আছেন, যারা ব্যাংকটিকে লুটপাট করেছেন, তারা একত্র হয়ে তাদের লোকদেরই ব্যাংকে বসাবেন। এ তথ্য পেয়ে তারা যাতে ব্যাংকে না ঢুকতে পারেন, সেজন্য আমরা ব্যাংকের সামনে অবস্থান নিই।
‘একপর্যায়ে এস আলমের লোকজন সিটি সেন্টারে অবস্থান নেয়। তারা মিছিল নিয়ে প্রধান কার্যালয়ে ঢুকতে চায়। তখন ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারা তাদের প্রতিহত করতে গেলে এস আলমের লোকজন তাদের উদ্দেশ্যে গুলি চালায়। তাতে সাতজন গুলিবিদ্ধ হন। তারা আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন। বৈষম্যবিরোধী ব্যাংকাররা সে সময় প্রতিরোধ করলে তারা (আক্রমণকারীরা) পালিয়ে যায়।’ সরকার পতনের পর থেকে ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারা ব্যাংকটির পর্ষদ পুনর্গঠনের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ‘লুটেরাদের’ বের করে দেয়ার দাবি জানান। এর আগে গত বৃহস্পতিবার ইসলামী ব্যাংক থেকে পদত্যাগ করেন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) কায়সার আলী।
গত মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর দিলকুশায় ইসলামী ব্যাংকের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সুবিধাবঞ্চিত কর্মকর্তারা বিক্ষোভ করেন। ওই দিন ব্যাংকটিতে এস আলমের নিয়োগ দেয়া কর্মকর্তাদের ঢুকতে দেয়া হয়নি। এর আগে ব্যাংকটির কালেক্টিভ বার্গেইনিং এজেন্টের (সিবিএ) শীর্ষ কর্মকর্তা আনিসুর রহমান বলেছিলেন, ২০১৭ সালের পরে যত এক্সিকিউটিভ এসেছেন, তারা আর এই ব্যাংকে ঢুকতে পারবেন না। আরো বলা হয়, ২০১৭ সালের পর থেকে সমস্ত অবৈধ পরীক্ষাবিহীন নিয়োগ বাতিল করা হবে। একইসাথে এই সময়ে যাদের অবৈধভাবে চাকরি বাতিল করা হয়েছে, তাদের চাকরি ফিরিয়ে দেয়া হবে। এ ছাড়া যারা গত সাত বছরে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তাদের যথাযথ পদোন্নতি দেয়া হবে।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিনের কঠোর অবস্থান : ইসলামী ব্যাংকের দখল নিয়ে গতকালের সঙ্ঘাত ও গোলাগুলিতে যারা জড়িত, তাদের শিগগির আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমি নিজেও একসময় ম্যাজিস্ট্রেট ছিলাম। এসব ধরপাকড় কম করিনি।
গতকাল রোববার সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিচিতি বৈঠকের পর সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি এ কথা বলেন।
ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গুলির ঘটনা ঘটেছে। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন পাঁচ কর্মকর্তা। ব্যাংকটির বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে সালেহ উদ্দিন আহমেদ আরো বলেন, কেউ আইনের বাইরে থাকবে না। যদি কেউ করে থাকে ইমিডিয়েটলি তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবো, যেই হোক।
এর আগে সকাল সোয়া ১০টার দিকে কয়েক শ’ বহিরাগত জোর করে ইসলামী ব্যাংকে প্রবেশের চেষ্টা করে। এ সময় বহিরাগত অস্ত্রধারীদের প্রবেশে বাধা দিলে কর্মকর্তাদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি চালানো হয়। এতে ইসলামী ব্যাংকের গোডাউন গার্ড শফিউল্লাহ সরদার, অফিসার মামুন, আব্দুর রহমান ও বাকিবিল্লাহসহ পাঁচ কর্মকর্তা গুলিবিদ্ধ হন।
ইসলামী ব্যাংকের এই পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমি বলছি কেউ আইনের বাইরে থাকবে না। যদি কেউ করে থাকে ইমিডিয়েটলি তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবো, যেই হোক।
কিন্তু ঘটনা তো ঘটেছে সাংবাদিকরা এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, নিশ্চয়ই জানে কারা ঘটিয়েছে, দেখেছে। আমি বিষয়টা নিয়ে আলাপ করব, দরকার হলে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে নিয়ে যাবো।
ব্যাংক থেকে টাকা তোলার ক্ষেত্রে সীমা আরোপ করা হয়েছে (দুই লাখ) এবং সেই সাথে এটিএম বুথে টাকা পাওয়া যাচ্ছে না। সাংবাদিকরা বলেন, এসব কারণে মানুষ বিপাকে পড়েছে। এ পরিস্থিতি কত দিন চলবে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘টাকা নেই, তা নয়। এটা করা হয়েছে নিরাপত্তাহীনতার কারণে। এটিএম বুথেও হামলা হয়েছে, সে জন্য শঙ্কা ছিল। অর্থ সচিব বিষয়টি দ্রুততার সঙ্গে দেখবেন।’
অর্থ উপদেষ্টা আরো বলেন, ‘আমি তো জানি, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকাররা প্রতিদিন বড় ট্রাংকে করে টাকা নিয়ে যান; কিন্তু এখন রাস্তা দিয়ে সেই টাকা পরিবহন করা বিপজ্জনক। সে জন্য এটা করা হয়েছে। পরিস্থিতি শিগগির স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
বৈঠকে কর্মকর্তাদের কী বার্তা দেয়া হয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে মানুষের জন্য কাজ করার কথা বলেছি। কোনো কিছু ফেলে রাখা যাবে না। সেই সঙ্গে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতের কথা বলেছি।
গভর্নর ও এনবিআর চেয়ারম্যানের নিয়োগ প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘এখন গভর্নর নিয়োগের বিষয়ে চিন্তিত, এনবিআরের বিষয় ভিন্ন। চেয়ারম্যান তো প্রশাসন থেকেই আসেন। গভর্নর ও সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান শিগগির নিয়োগ দেয়া হবে।’
এর আগে অর্থ উপদেষ্টা অর্থ বিভাগের বিভিন্ন কর্মকর্তার সাথে পরিচিতমূলক বৈঠক করেন। এতে অর্থ সচিব ড. খায়রুজ্জামান মজুমদার, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো: রাহমাতুল মোনেম, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব মো: শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ইআরডি সচিব বলেন, বৈদেশিক ঋণের স্থিতি নিয়ে এখুনি কোনো দুশ্চিন্তার কারণ নেই। আইএমএফের পরিসংখ্যান বলছে, বৈদেশিক ঋণ নিয়ে বাংলাদেশ কোনো ঝুঁকিতে নেই।
Source: The Daily Nayadigonto Online