আরাকান আর্মিকে নৃশংসভাবে দমনের চেষ্টা

Spread the love
আরাকান আর্মিকে নৃশংসভাবে দমনের চেষ্টা করেছিল তারা। এরপরে বার্মিজ জান্তার এলাই হয়ে রোহিঙ্গাদের বাসভূমি আরাকান থেকে উচ্ছেদ করা হল। বাংলাদেশের সরকারকে বাধ্য করা হল সীমান্ত খুলে ১১ লক্ষ রোহিঙ্গাদের স্থান দিতে। তারা নিজেদের দুই অংশের সমুদ্র সংযোগ করতে ইকোনোমিক করিডোরের কাজ শুরু করলো, কালাদান মাল্টি-মোডাল ট্রানসিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট। (কলকাতার হুগলি বন্দর থেকে সমুদ্রপথে আরাকানের সিত্তে হয়ে বার্মার পালতোয়াকে সংযুক্ত করে সামরিক ও বাণিজ্যিক রুট চালু, এখানে আছে নদীপথ-সমুদ্রপথ-এবং মহাসড়ক।)
অপরাপর প্রয়োজনের পাশাপাশি ভারতের এই সামরিক-বেসামরিক প্রকল্পের সারফেইস গ্রাউন্ড লিংক গুলোকে সিকিউর করতে, ২০১৯ সালে শেখ হাসিনাকে দিল্লিতে ডেকে কোস্টাল সারভেইলেন্স রাডার স্থাপনা চুক্তি করতে বাধ্য করা হল। বাংলাদেশের কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে একটা মেগা ডিজাস্টার ছিল। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সকল কৌশলগত সক্ষমতা, কারিগরি অবকাঠামো প্রস্তুতি এবং বাংলদেশের মেরিটাইম সুরক্ষাকে, ফোর্সেস গোল ২০৩০ এর আলোকে নতুন করে কেনা অত্যাধুনিক টেকনোলজির ফাংশনালিটিকে ভারতের হাতে তুলে দেয়ার প্লট হল।
বাংলাদেশ নৌবাহিনী এই এলাকায় বাণিজ্যিক সী লাইন অফ কমিউনিকেশন (স্লক), ওয়াটার টেরিটরিজ, মেরিন ফিশারিজ, মেরিটাইম সিকিউরিটি, হাইড্রোকার্বন রিজার্ভ ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও সম্পদ ব্যবস্থাপনার সার্বিক নিরাপত্তায় নিয়োজিত। একটি নৌবাহিনীর অন্যতম কৌশলগত অবকাঠামো হল তার সার্ভেইলেন্স ইনফাস্ট্রাকচার। ঠিক এটাই ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে দাসবৃত্তিক সরকার। এর ফলে বে অফ বেংগলে ভেসেলের মুভমেন্ট জানতে পারে ভারত। বাংলাদেশ নৌবাহিনী তাদের ডেটা দিতে বাধ্য, ফলে তারা লিগ্যালি ট্রেক এন্ড ট্রেইসও করতে পারে।
মানে হচ্ছে, নেভির আধুনিকায়নে টাকা খরচ আমাদের কিন্তু এই চুক্তির পরে আমাদের সেনসিটিভ সামরিক ও বেসমারিক প্রয়োজনে আমাদের যন্ত্রপাতির ফাংশনালিটি বা কার্যকরিতা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হল। প্লাস কমার্শিয়াল শিপের ডেটা শেয়ার হইলো।
নতুন দফা ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনে সমর্থনের পরে, ২০২৪ সালে শেখ হাসিনাকে আবারও দিল্লিতে ডেকে সম্ভবত হোয়াইট শিপিং চুক্তির কথা জানানো হইলো (মিডিয়া স্ট্যাডি, সরকার এসব তথ্য নাগরিকদের কিংবা সংসদকে জানায় না), এতে নেভির সামরিক ও গোয়েন্দা তথ্য শেয়ারিং এর বাধ্যবাধকতা তৈরী হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সাথে আকসা ও জিসোমিয়া করতে চেয়েছে, যাতে এরকম এলিমেন্ট আছে কিছু। ভারত এসব ফ্রেইমওয়ার্ক সেরে ফেলেছে।
মিডিয়া বলছে, দুদেশের মধ্যে মেরিটাইম কো-অপারেশন ও ব্লু ইকোনমিতে একটি সমঝোতা স্মারক বিনিময় করা হয়েছে। এতে উভয় দেশ সমুদ্র নিরাপত্তা, সহযোগিতা ও ব্লু ইকোনমি খাতে সুযোগ অন্বেষণে সম্পর্ক জোরদার করবে। বাস্তবে এসব চুক্তি সুফল শুধু ভারতই পায়।
অর্থাৎ কালাদান মাল্টি-মোডাল ট্রানসিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্টকে বাণিজ্যিক ও সামরিকভাবে সাকসেস করার সব আয়োজন সম্পন্ন হইলো।
দুই
আরাকান আর্মি আরাকানের উল্লেখ্যযোগ্য অংশ দখলে নিলে কালাদান প্রকল্প আপাতত ফলহীন। এমতাবস্থায় দু’ধরনের নতুন চাপ (সরকারকে অবৈধ ক্ষমতায় সমর্থন দিয়েছে বলে এটাকে আবদার বলা যায় না) নিয়ে হাজির হয়েছে তারা।
১. বাংলাদেশের দুর্বল এবং দাস সরকারকে বাধ্য করে আমাদের বাহিনীগুলোকে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে এবং জান্তার সাথে সহযোগিতামূলক ভূমিকা নিতে বাধ্য করা। এটা সুস্পষ্টভাবে বাংলাদেশের স্বার্থের বিপক্ষে। কেননা বার্মা বর্ডারে আরাকান আর্মি বাংলাদেশের নতুন প্রতিবেশী হয়ে ওঠায় তাদের সাথে আমাদের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্পর্কিত ডিলে যাবার স্বার্থ আছে। আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে গিয়ে স্বল্প ও মধ্য মেয়াদে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন করতে পারবে না।
২. চায়নার সাথে পাল্লা দিয়ে শিলিগুড়ি/পঞ্চগড় চিকেন নেকের সুরক্ষা দিতে, ১৪টি নতুন রেলপথে সংযুক্ত হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে তারা। পাশাপাশি পদ্মা সেতু ব্যবহার করে কলকাতা থেকে আগরতলা যেতে সরাসরি সড়ক ট্রেন ট্রানজিট, করিডোর এবং ট্রান্সশিপমেন্ট সব নিতে চাইছে। আগেই নৌ ও সড়ক ট্রানজিট নিশ্চিত করেছে, বলতে গেলে বিনা মূল্যে বিনা শুল্কে। মংলা ও চট্রগ্রাম বন্দরের অগ্রাধিকার ভিত্তিক ব্যবহার সুবিধা দেয়া হয়েছে। এখন চলছে বাণিজ্যিক ও সামরিক প্রয়োজনে রেল ট্রানজিট, করিডোর এবং ট্রান্সশিপমেন্ট এর চাপ।
একদিকে ট্রানজিট থেকে বাণিজ্যিক লাভ নেই বরং নির্মান ও রক্ষনাবেক্ষম মিলিয়ে শুধু লোকসান। বাংলাদেশকে জাইকা, এডিবি, চীন এবং বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সড়ক, সেতু, রেল অবকাঠামো করে দিতে হবে, এসব ব্যবহার করবে ভারত। বিপরীতে আসবে না নির্মাণ খরচ, রক্ষনাবেক্ষন খরচ। আসবে না উল্লেখযোগ্য ট্রানজিট, করিডোর এবং ট্রান্সশিপমেন্ট ফি। একইভাবে বাংলাদেশ বিদেশ ঋণ নিয়ে নৌ ট্রানজিটের রুটে ড্রেজিং করবে।
জল স্থল রেল ট্রানজিট, করিডোর এবং ট্রান্সশিপমেন্ট এর পাশাপাশি চলছে বিদ্যুৎ করিডোর, এমওইউ হয়ে গেছে। আকাশ নেভিগেশনে বাংলাদেশকে দিচ্ছে না রাডার বসাতে। বাণিজ্যিকভাবে যত বিমান/উড়োজাহাজ বাংলাদেশের আকাশ সীমায় উড়ে তার রুট ফি নিয়ে নেয় ভারত।
এভাবেই দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও উষ্ণ বন্ধুত্বের নামে অর্থনৈতিক অত্যাচার চলছে। এমতাবস্থায় একটা আঞ্চলিক সংকটে বাংলাদেশের স্থল, রেল, নৌ এবং সাগর সীমার কৌশলগত সব নিরাপত্তাও অরক্ষিত হয়ে গেছে।
এখানে ছোট হলেও উল্লেখ করার মতো আরও দুটি বিষয় হচ্ছে, এক- কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় বরাদ্দকৃত স্থান থেকে ভারতীয় ইপিজেড ফেনী-মুহুরি চিকেন নেকের কৌশলগত বঙ্গবন্ধু ইপিজেড অঞ্চলের স্থানান্তর করা। এবং দুই- বাণিজ্যিক ফিজিক্যালিটি না থাকা সত্ত্বেও ফেনী নদীর উপর দিয়ে কয়েকশো কোটি টাকা খরচ করে ফেনী ব্রিজ তৈরি করে দেওয়া। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের এই অংশ সম্ভাব্য ঝুঁকিতে পড়লো। ফেনীর এই ‘চিকেন নেক’ চট্টগ্রাম বিভাগের কৌশলগত সামরিক নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাক আর্মি এটা রক্ষার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। সামরিক ‘চেক এন্ড ব্যালান্স’ ছাড়া অবকাঠামো উন্নয়নের নামে এসব কৌশলগত বিষয় ছেড়ে দেয়া হয়েছে, যদিও ফেনী-ত্রিপুরা রুটে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্ভাবনা নেই কিংবা রাজস্ব আয়ও আসছে না।
প্রশ্ন হচ্ছে, এসব স্পর্শকাতর সামরিক ও বেসামরিক কৌশলগত বিদেশী চুক্তিতে দেশের আর্মি ইন্টেলিজেন্স, সামরিক গোয়েন্দা, আইএসপিআর কিংবা আলাদাভাবে সেনা বিমান ও নৌবাহিনীর মতামত নেয়া হচ্ছে কিনা? চুক্তির প্রিএম্বেল এবং টার্মসে তাদের কৌশলগত ভেটিং করা হচ্ছে কিনা? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাউথ এশিয়া ডেস্কের মাধ্যমে গভীর স্ট্যাডি করানো হচ্ছে কিনা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রশ্নে একাডেমিয়া এবং বেসরকারি নিরাপত্তা বিষয়ক থিংক ট্যাংকদের এনগেইজ করা হচ্ছে কিনা, নাকি একতরফা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে এসব চুক্তি হচ্ছে?
তিন
আগের দেয়া ট্রানজিট, করিডোর/ট্রান্সশিপমেন্ট বা দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও কানেক্টিভিটির এলিমেন্ট উইন উইন হইলে নতুন রেল সংযোগের বাণিজ্যিক আলাপ তোলা যেত। কেইস স্ট্যাডি করা যেত। কিন্তু- ক। শুধুমাত্র যাত্রী পরিবহন দিয়ে রেল বাংলাদেশে কখনও লাভজনক হয়নি। খ। গত দশ বছরে ভারত থেকে আমদানি ৩ গুণ হয়েছে, অর্থাৎ বিদ্যমান স্থল ও নৌ বন্দর অবকাঠামো ভারত বাংলাদেশের বাণিজ্য বিকাশে কোন ব্যারিয়ার হয়নি যে রেল লাগবে। ইনফ্যাক্ট ১৯৬৫ পূর্ব রেললাইন সব সচল করা হয়েছে, আমরা সেসবের বিরুদ্ধে কথা বিলিনি। গ। বাংলাদেশ রেলের অন্তত ১০০+ পুরানো সেতু বৃটিশ আমলের। সেসবে অর্থায়নে অভাব আছে। ঘ। দেশ ডেবট সার্ভিসের ক্রাইসিসে পড়ছে, এমতাবস্থায় ভারতের চিকেন নেকের সুরক্ষার জন্য কানেক্টিভিটির প্যাকেজে আসা নতুন রেলের জন্য বিদেশি ঋণের উল্লেখযোগ্য দায় বাংলাদেশের উপর আসবে। ঙ। আমরা মনে করি না, ভারত ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য এমন উল্লেখযোগ্য কোন ফি দিবে যা দিয়ে অপারেশন কস্ট, সিকিউরিটি এবং লোনের দায় উঠে আসবে। এর আগে দশভাগের এক ভাগ টোলে/বিনা মানশুলে ট্রানজিট দেয়া হয়েছে। টানজিট থেকে বিলিয়ন ডলার আয়ের খোয়াব দেখনো হয়েছে বিপরীতে কোটি টাকা আয় হবার সম্ভাবনা তৈরি হয়নি। বস্তুত ট্রানজিট ট্রানশিপমেন্ট ও করিডোরের উদ্দেশ্য দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য নয় বরং ভারতের নিরাপত্তা সমাধান এবং সামরিক প্রয়োজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *